Tuesday, July 22, 2025

সীমানা

 সীমানা

হিরণ্য জ্যোতি


AYMARI


জগন্ময় ধর


গার্গী


প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা ৬৩ আনন্দ পালিত রোড কলিকাতা- ৭০০০১৪

বিকেল চারটা নাগাদ সেন্ট্রাল এভিনিউর কফি হাউসে একা একা বসে কফি খাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি সীমানা এসে ঢুকলো, ও আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করল মুখার্জিদা কেমন আছেন? আমার উত্তর পাওয়ার অপেক্ষা না করে আমার টেবিলে এসে বসলো। ওর বয়স পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই হবে। ভদ্র শাড়ি ব্লাউজ পরেই সে এসেছে। ওর ব্যক্তিত্ব চোখে পড়ার মত। সরু ফ্রেমের চশমা। ওর ব্যক্তিত্ব এমনই যে সব পুরুষকেই ওকে যথেষ্ট সমীহ করে কথা বলতে হবে।


সীমানা ব্যক্তিগত কারণে বিয়ে করেনি। ওর সঙ্গে আজ ৪/৫ বছর পর দেখা। ও যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে Mathematics নিয়ে M.Sc. পাশ করেছিল। ভাল স্কুলে চাকরি করত, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যে কোন কারণেই হউক মতের মিল না হওয়ার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে উঁচু ক্লাসের ছেলে মেয়েদেরকে গ্রুপ করে করে পড়াচ্ছে।


আমি হরিশ মুখার্জি রোডে ওদের পাড়াতে ছিলাম। বেশ কিছুদিন হয় বোসপুকুরে ফ্ল্যাট কিনেছি। আমিও যাদবপুরে পড়াশুনা করেছি। যাদবপুরের ছাত্র ছিলাম এই বলে আগে খুব গর্ববোধ হত, কিন্তু আজ এই ছাত্র সমাজ দুষিত পরিবেশের প্রবাহে উশৃঙ্খলতাকে প্রশ্রয় দিয়েছে। ছাত্র সমাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারছে না। এই সমস্যার সমাধান কি করে করা যায় তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ হিমসিম খাচ্ছেন। আমরা পরস্পর এই নিয়েই আলোচনা করছিলাম আমাদের সময় সুশৃঙ্খলতা বজায় রেখে সংগঠন করা হত। নেতার যথেষ্ট সংগঠন পরিচালনা করার দক্ষতা ছিল, যোগ্যতাও ছিল। নেতাকে সবাই পথপ্রদর্শক বলত।


আজ নেতারা সঠিক নেতৃত্ব দেওয়ার বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছে। যুব সমাজ, ছাত্র সমাজ এই উপযুক্ত নেতার অভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে এগিয়ে


৫০

যেতে পারছে না, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সংগঠনের শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এতই ভেঙে পড়েছে জোড়া লাগাবার লোকের অভাব। বর্তমান ছাত্রসমাজের কথা আলোচনা করে আমাদের মন খুব বিষণ্ণ হয়ে গেল এবং ওদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে খুবই চিন্তা ও কষ্ট হচ্ছিল।


সীমানা শিক্ষাজগতে থাকাতে কর্তৃপক্ষের শিক্ষা ব্যবস্থা খুব গুরুত্ববিহীন হয়ে পড়েছে তা আমার কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে গেল। আমি নিজেকে শিক্ষার জগৎ থেকে অনেকদিন আগেই গুটিয়ে নিয়েছিলাম। আমি ব্যবসা করি, তবে শিক্ষা নিয়ে যে আলোচনার খুব প্রয়োজন তা ভুললে চলবে না।


আমাদের কফি খাওয়া হয়ে গেল। প্রায় পৌনে পাঁচটা বাজে। আমরা উঠব ভাবছি, হঠাৎ দেখি উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর স্ট্রীটের সৃজিৎ বোস ঢুকলেন। উনিও যাদবপুরের ছাত্র ছিলেন, তবে আমার সিনিয়র। এখন বয়স ৬০/৬৫ হবে। কেন্দ্রিয় সরকারের উচ্চপদে চাকরি করতেন। আমার সঙ্গেই পরিচয় ছিল। আমাকে দেখে আমার টেবিলেই এসে বসলেন। সীমানার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। সীমানা যাদবপুরের ছাত্রী ছিল বলে ওকে মর্যাদা দিতে ত্রুটি করলেন না। বোসবাবুর সঙ্গে বেশ কিছুদিন পর দেখা হলো। উনি বরাবর ধূতি পাঞ্জাবী পরতেন। উত্তর কলকাতার আদি বাসিন্দাদের ধুতি পাঞ্জাবী পরারই প্রচলন বেশি ছিল। বোসবাবু সুশিক্ষিত, সংস্কৃতি সম্পন্ন ও খুবই রুচি সম্পন্ন ভদ্রলোক। ঘিলে করা পাঞ্জাবী ও চশমা দেখলেই বোঝা যায় উনি উত্তর কলকাতার লোক। আমি ওনার কফির অর্ডার দিয়ে দিলাম যেহেতু উনি আমার টেবিলেই এসে বসেছেন। উনি খুব ভাল ছোট গল্প লিখতে পারতেন। পূজা সংখ্যায় ওনার লেখা বেরুতো। আমার টেবিলে বসেই বললেন আজকাল বিজ্ঞানের প্রযুক্তিতে সবই হারিয়ে যেতে বসেছে। কাগজে লেখালেখির কাজও উঠেই যাবে। শিক্ষার মান বাড়িয়ে বেকার সমস্যার সমাধান তো দূরের কথা বেকার সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষিত যুবসমাজ চাকুরি করে আর্থিক সংস্থার ব্যবস্থার কোনও সুযোগ খুঁজে না পেয়ে বাঁচার জন্য অসামাজিক কাজে লিপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এত লোকসংখ্যা বহণ করাই এখন ধরিত্রীর বড় চিন্তা। যথাযথ আমাদের আলোচনার মূল বিষয় বস্তু হলো বর্তমানে চাপিয়ে দেওয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা, রাজনৈতিক দ্বন্দু, অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ায়, অবহেলিত নারী সমাজ, পারিবারিক একে অন্যের বোঝাপড়ার অভাব, সমাজবিরোধীদের দৌরাত্ম্য, শহরে, জেলায় জেলায়, গ্রামে গঞ্জে পুলিশ প্রশাসন চেষ্টার ত্রুটি করছেন না। শান্তি শৃঙ্খলা


৫১

আনার, কিন্তু দেখা যাচ্ছে আইন শৃঙ্খলা নেই বললেই চলে। টিভির দৌলতে দ্রব্যের বিজ্ঞাপণ দেখাতে গিয়ে অশ্লীলতা কতটুকু নামানো যায় তা নিয়ে প্রস্তুতকারকরা প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছেন। অসামাজিক কাজ প্রাধান্য দিয়ে নাটকের প্রস্তুতকারকরা সমাজের কথা ভুলে গিয়ে তাদের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আরও পোক্ত করার চেষ্টা করছেন। সমাজের আবালবৃদ্ধবনিতা এই দেখে ওরা কি পারে সে দিকে ওনারা চোখ বন্ধ করে রেখেছেন। ছোট বড় সবাই আগ্রহ নিয়ে দেখাচ্ছে ও কৌতূহল নিয়ে গুরুজনকে জিজ্ঞেস করছে অনেক প্রশ্ন। এই দেখে ছোটদের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। কাগজ পড়ে, টিভি দেখে মনে হয় নারী যেন বস্তু বা দ্রব্যসামগ্রী হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের আলোচনার পরিবেশের প্রভাবে পাশের টেবিলের আরও কয়েকজন অপরিচিত শ্রোতা আমাদের আলোচনায় অংশ নিলেন। আমরা এক ব্যাপারে সবাই একমত, সব কিছুরই আলোচনা হয়, সমালোচনা হয়, পর্যালোচনা হয়, ব্যস, করা উচিৎ বলার গন্ডির থেকে বেরুতে পারে না। সবই আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ। সুশৃঙ্খল সমাজ তৈরী করতে হবে নিজের নিজেদের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে হবে সঙ্গবদ্ধভাবে।


সাড়ে পাঁচটা বাজে বোসবাবুর মোবাইল ফোন বেজে উঠলো, ওনার ছেলের বৌ অনুরাধা জিজ্ঞেস করছে বোসবাবু পাঁচটার ঔষধ খেয়েছেন কি না এবং বলে দিচ্ছে সুগারফ্রি দিয়ে কফি খেতে। আমি জিজ্ঞেস করলাম বৌদি কি ফোন করেছে, দেখুন তো বৌদি আপনার কত খেয়াল রাখে। তার প্রত্যুত্তরে বোসবাবু বললেন, না না আমার অভিভাবিকা সে কে? আমার ছেলের বৌ অনুরাধা বোস। আজ ২/৩ বছর হয় অনুপমকে বিয়ে করিয়েছি। কাগজ দেখে। কবীর রোডের মেয়ে। ব্র্যাবর্ন কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকনমিক্স নিয়ে এম. এ. পাশ করেছে। বাবা মা-র একই মেয়ে। পারিবারিক লোকজনদেরকে আপন করার শিক্ষাটা বাবা-মার কাছ থেকে খুব ভালভাবে পেয়েছে। ওরাই তো সমাজের পথপ্রদর্শক। ওর মা প্রফেসার, বাবা রাজ্য সরকারের কর্মচারী। ওরা যথেষ্ট সচ্ছল। বোসবাবু বললেন আমাদের মেয়ে নেই। কিন্তু তোমার বৌদিও আমাকে শাসন করে ও ভালবেশে এত কাছে টেনে নিয়েছে চিন্তা করতে পারবে না। আমাদের সব সমস্যা ও-ই মাথায় নিয়ে নিয়েছে। আমাদের মেয়েও বোধহয় এত খেয়াল করত না। সকাল থেকে রাত অব্দি আমরা কি খাব, কি ওষুধ খাব, আমাদের বলার অপেক্ষা করে না। আমাদেরকে জিজ্ঞেস করেই সাপ্তাহিক


রান্নার চার্ট করে দিয়েছে। আমাদের মন রাখার জন্য হোক বা ভালবেসেই হোক অনুরাধা নিজে রান্না করে। তোমার বৌদি তো রান্না ঘরের দরজাই ভুলে গিয়েছে। অতিথিদেরকে কি ভাবে আবাহন ও আপ্যায়ন করা উচিৎ তা ওর কাছ থেকে শিক্ষনীয়। ওর চালচলন, ভদ্র ব্যবহার, আদবকায়দা, কথা বলার ধরণ, ভদ্র পোষাক পরে চলাফেরা করা খুবই লক্ষণীয়। সবাইকার মন জয় করে সবাইকার কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে। আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিতে ওর কোন ত্রুটি নেই। ও-ই সবাইকার যোগসূত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার সারা সপ্তাহের ধুতি পাঞ্জাবী প্রেস করে সাজিয়ে রেখে দেয়। আমার শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক সব দিকেই ভীষণ নজর দিয়ে থাকে। অনুপমকে প্রথম দিনই বলে দিয়েছে বাবা মার প্রতি কর্তব্যের যেন কোন রকম গাফিলতি না হয়। অনুরাধা বলে দিয়েছে, সে-ও এই পরিবারের একজন স্থায়ী সদস্য। সে-ও পরিবারকে সুস্থ রাখার জন্য দায়বদ্ধ। সে চায় আমাদের দৈনন্দিন জীবনটা যেন মধুর থেকে আগামীকাল আরও মধুরতর হয়। প্রতি মাসে আমাদেরকে ডাক্তার দিয়ে চেক আপ করার পুরোপুরি দায়িত্ব ওর ঘাড়ে নিয়ে নিয়েছে। তবে আমিও যখন বাড়ি ফিরি ওর পছন্দমত খাবার নিয়ে আসে। আমাকেও ওকে কাছে টেনে নিতে হবে। বোসবাবুর শ্যামপুকুরে তিনতলা বাড়ি। নীচতলায় ভাড়াটে। দু-তলায় ছয়টা ঘর। অনুরাধা দক্ষিণের দুটো ঘরই শ্বশুর শাশুড়ির থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বোসবাবুকে ফ্লাস্কে খে কফি দিয়ে থাকে, কারণ ওনার খুব কফি খাওয়ার নেশা। শাশুড়ি গল্পের বই পড়তে ভালবাসেন, অনুরাধা পূজা সংখ্যার সবকটা বইই শাশুড়ির জন্য কিনে এনেছে। বোসবাবু বললেন ওর দাম্পত্য জীবনও খুব সুখের। বরের প্রয়োজনীয় জিনিষ সব সময় হাতের কাছে রেখে দেয়। ও অনুপমকে বলেছে এতদিন তোমার মা বাবা কষ্ট করে ধরে রেখে ছিলেন সংসারকে। তোমার শৈশবকাল থেকে চাকুরি পাওয়া অব্দি কি পরিশ্রমই না করেছেন। আজ তুমি প্রতিষ্ঠিত হয়ে এত বড় চাকরি করছ। তোমার প্রতিষ্ঠিতের পিছনে তোমার বাবা-মার অবদান অনস্বীকার্য। আমি অংশীদার হিসাবে তোমার সঙ্গে আছি, তুমি প্রতিদান দিতে ভুল করবে না, তা না হলে বিধাতা অভিশাপ দেবেন। অনুপম বাড়িতে এসেই মা বাবার কাছে প্রথমে হাজিরা দিয়ে নিজের ঘরে যায়, তারপর মায়ের ঘরে বসেই চারজনে চা খায়। অনুরাধা এই বাড়িতে এসে এই নিয়মগুলি চালু করেছে।


বোসবাবু বললেন বর্তমান পরিবেশে আমার ছেলের বৌ দৃষ্টান্ত। ওর


৫৩


এত শিক্ষাগত যোগ্যতা, কিন্তু কোনো অহমিকা নেই। সবার কাছে আমাদের মাথা উঁচু করে দিয়েছে। ওর সব কাজই প্রশংসনীয়। এখন নাতি নাতনির মুখ দেখার অপেক্ষায়। প্রায় সাড়ে ছয়টা বেজে গেল, এবার ওঠা যাক, এত সময় বোসবাবুর কাছ থেকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ ছেলের বৌয়ের মন জয় করার কৃতিত্ব শোনা গেল এবং সবাইকে বলার বিষয় হয়ে রইল। সীমানা শুধু ওঠার আগে বললো মেয়েটা সর্বগুণে গুণী। আশীর্বাদ করছি ও যে আপনাদেরকে সব সময় আনন্দ দিয়ে থাকে। এরকম বাড়ির বৌ হলে পারিবারিক অনেক সমস্যাই মিটে যাবে।


৫৪

No comments:

Post a Comment

ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুপ্রেরণা কী? ইসলাম সম্পর্কে ঋত্বিক ঘটকের বক্তব্য কী?

 ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র নির্মাণের অনুপ্রেরণা কী?  ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রে দেশভাগ এবং সামাজিক বিষয়গুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করা মূলত বঙ্গভঙ্গে...